‘নির্যাতনে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
Deprecated: preg_split(): Passing null to parameter #3 ($limit) of type int is deprecated in /home/barishaldorpon/public_html/wp-content/themes/jannah/framework/functions/post-functions.php on line 791
পুলক চ্যাটার্জি, অতিথি প্রতিবেদক : বরিশালের ওয়াপদা কলোনিতে টানা ১৯ দিন পাকিস্তানি হানাদারদের টর্চার সেলে বন্দি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এ.এম.জি কবীর ভুলু। তখন তিনি ২৪ বছরের টগবগে তরুণ। টর্চার সেলে প্রতিদিনই তার ওপর চলত হানাদারদের সীমাহীন অত্যাচার। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খোঁচাতো। পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে পেটানো হতো। যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, এভাবেই চলত নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর পরেও তাকে সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি বলেন, সেই নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম।
নগরীর কালীবাড়ি সড়কের শীতলাখোলা এলাকার বাসিন্দা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ.এম.জি কবীর ভুলু পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন থেকে একপর্যায়ে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। অনেকের ভাগ্যে তাও জোটেনি। মৃত্যুই ছিল তাদের নিয়তি। কবীর ভুলুর বর্ণনায়- সন্ধ্যা নামলেই টর্চার সেলের বিভিন্ন ভবন থেকে শোনা যেত নারী-পুরুষের আর্তনাদ। কলোনির একাধিক টর্চার সেলে বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর সাগরদী খালের পাড়ে এবং খালের ওপরে একটি ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো।
হানাদারদের হাতে বন্দি হওয়ার বর্ণনা দিয়ে কবীর ভুলু বলেন, একাত্তরের মে মাস। আমাদের ক্যাম্প ছিল স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানা স্কুল। আমরা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ওই ক্যাম্পে ছিলাম। সেখানে বাউকাঠি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর দিন পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেলে। আমরা অস্ত্র নিয়ে যে যার মতো পালিয়ে যাই। সঙ্গে থাকা এলএমজি নিয়ে আমি চলে গেলাম আগৈলঝাড়ায় গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে অস্ত্রটা মাটিচাপা দিয়ে রেখে আবার ফিরে আসি সদর উপজেলার চরকমিশনার এলাকার করিম হাওলাদারের বাড়িতে। সেখানে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা মিলিত হয়ে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিই। তখন আবার বাড়িতে গিয়ে মাটির নিচ থেকে এলএমজিটা নিয়ে নৌকায় করে চরকমিশনারের দিকে আসতে থাকি। পথে ১৬ জুলাই সকালে গৌরনদীর বাটাজোর খালে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে যাই। নৌকার মাঝি মেহের আলী, আনোয়ার ও আমাকে ওই দিন নিয়ে রাখা হয় গৌরনদীর সরকারি কলেজের সেনা ক্যাম্পে। সেখান থেকে বাটাজোর সেনাক্যাম্পে নিয়ে আমাদের ওপর চলে নারকীয় নির্যাতন।
এ.এম.জি কবীর ভুলু বলেন, পাকিস্তানি হানাদাররা বারবার জানতে চাইতো- ‘মেজর জলিল কাহা হ্যায়, মনজু (নুরুল ইসলাম মনজুর) ক্যাহা হ্যায়, মুক্তি কাহা হ্যায়?’ ‘তুম সাচ সাচ (সত্য) বাতাও, তুমকা ছোরদেয়া’। ওদের কথার কোনো জবাব না দিলেই শুরু হতো অকথ্য নির্যাতন। ওইদিন হাত-পা বেঁধে সমস্ত শরীর বুট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়। চড়থাপ্পড়ে দুই কান দিয়ে ঝরছিল রক্ত। নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম। মনে হয়েছে নির্যাতন না চালিয়ে গুলি করে মেরে ফেললেও ভালো হতো। সন্ধ্যায় আমাকে এবং মেহের আলী ও আনোয়ারকে এক রশিতে বেঁধে জিপে করে নিয়ে আসা হয় বরিশাল নগরীর ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে। আমাদের যে কক্ষে রাখা হয়েছিল সেখানে আরও ছিলেন ফুটবলার স্বপন, গৌরনদীর অধ্যক্ষ অজিত চাকলাদার ও মাধবপাশার মাখনলাল। লাগাতার নির্যাতনে ১৭ জুলাই রাতে মারা যান আনোয়ার। তবে কয়েকদিন পর মেহের মাঝিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর আমার ওপর টানা ১৯ দিন চলে দফায় দফায় নির্যাতন।
কবির ভুলু বলেন, ১৯ দিন পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে নিয়ে রাখা হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২১ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় আমাকে। ছাড়া পেয়ে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে আবার যুদ্ধে অংশ নিই। ( তথ্য সূত্র: সমকাল )